॥ মাসুদ রানা, বাগেরহাট জেলা প্রতিনিধি ॥
মোংলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিস সহকারী মহারাজের দাপটে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। ছোট পদে চাকরি করলেও অনেক বড় দায়িত্ব পালন করেন তিনি! সদ্য সাবেক ইউএনও এবং সাবেক সাংসদের প্রভাব খাটিয়ে কামিয়েছেন অঢেল টাকা। দখলে রেখেছেন উপজেলা প্রশাসনের অধিকাংশ দপ্তর। তার খবরদারীতে আতংকে থাকতেন কর্মকর্তারা। এমনটাই অভিযোগ জনপ্রতিনিধি ও অফিসপাড়ার কর্তাদের।
সেই দাম্ভিকতায় উপজেলা পরিষদের সকল দপ্তর পিওন মহরাজের কব্জায় চলে আসে। এখানের কর্মস্থলে যোগদানের পর সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাও পিওন মহারাজকে বেশ গুরুত্ব দিতেন। সুচতুর এ পিওন যা বলতেন তা বিদ্যুৎ গতিতে করতেন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিশাত তামান্না।
তারা জানান, উপজেলা পরিষদের কৃষি, জনস্বাস্থ্য, পিআইও, আইসিটি ও সমাজসেবা অধিদপ্তর সহ সকল বিভাগের কর্মকর্তারা থাকেন পিওন মহারাজের নজরদারীতে। সকল দপ্তরে নানা তদ্বির করেন তিনি। অর্থের বিনিময় এ সকল দপ্তর থেকে কাকে কি সুবিধা পাইয়ে দিতে হবে তা তিনি ভালই জানেন। দাপ্তরিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তার তদ্বিরে রাজী না হলে তার বিরুদ্ধে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে কানভারি সহ আটেন ষড়যন্ত্রের জাল। শুধু সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা নয়, পিওন মহারাজের দাপটে নাজেহাল হচ্ছেন ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যরা।
উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে হাট-বাজার ইজারায়ও রয়েছে তার কারিশমা। কম টাকায় ইজারা টেন্ডার পাইয়ে দেয়ার তদ্বিরে বেশ পারদর্শী তিনি। জনস্বাস্থ্যের ট্যাংকিও ৫ থেকে ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের নানা সুবিধাদীর বানিজ্য রয়েছে তার হাতে। মাত্র ১১ মাস আগে মোংলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে পিওন পদে বদলী হয়ে আসেন তিনি। এখানে আসার পর সুচতুর মহারাজকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তার বাড়ি পাশের উপজেলা বাগেরহাটের রামপালের মল্লিকের বেড় গ্রামে।
খুলনা সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকের বদৌলতে চাকরি পেলেও আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের পর তার ভোল পাল্টে গেছে। তালুকদার আব্দুল খালেকের সঙ্গে তার গ্রাম্য ও পারিবারিক বিরোধ এবং শত্রু থাকার কথা চাউড় করছেন।
অথচ সেই তালুকদার আব্দুল খালেকের পত্নী সাবেক স্থানীয় আ’লীগ দলীয় সংসদ সদস্য বেগম হাবিবুন নাহারের সুপারিশে মোংলা উপজেলায় বদলী হয়েছিলেন তিনি। আর সেই দাম্ভিকতায় উপজেলা পরিষদের সকল দপ্তর পিওন মহরাজের কব্জায় চলে আসে। এখানের কর্মস্থলে যোগদানের পর সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাও পিওন মহারাজকে বেশ গুরুত্ব দিতেন। সুচতুর এ পিওন যা বলতেন তা বিদ্যুৎ গতিতে করতেন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিশাত তামান্না।
দাপ্তরিক কাজের বাইরেও তিনি সকল দপ্তরের ফাইলপত্র, আয়-ব্যায় থেকে শুরু করে সকল কার্যক্রম নজরদারী ও খররদারি করেন। করতেন অনৈতিক তদ্বির বানিজ্য। আর নুন থেকে চুন হলে তার ফোন চলে যেতে তৎকালীন এমপি’র কাছে। তাই উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা এ পিওনের ভয়ে-আতংকে থাকতেন।
সাবেক এমপি’র বিরাগভাজন ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের উপর করতেন কড়া নজরদারী। এমনকি উপজেলার ৬টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার সকল জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিয়ন্ত্রনে থাকলেও তাও দেখতেন পিওন মহারাজ।
জনপ্রতিনিধিদের ডেকে প্রতিটি জন্মনিবন্ধন বাবদ তাকে ১শ’ টাকা করে ফি নির্ধারণ করে দিয়ে ছিলেন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। এ নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যানরা আপত্তি তুললেও কাজ হয়নি। এ জন্মনিবন্ধন বানিজ্যে পিওন মহারাজের মাসিক আয় গিয়ে দাড়ায় প্রায় ৫ লাখ টাকার কাছাকাছি।
এ ছাড়া ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে আবাসনের ঘর পাইয়ে দেন তিনি। উপজেলা পরিষদের এমন কোন দপ্তর নেই যেখানে অফিস চলাকালীন পদচারনা ও তদ্বির নেই। রক্ষা পায়নি ইউনিয়ন পরিষদের দপ্তরও। কখনও সাবেক সংসদ সদস্য আবার কখনও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নাম ভাঙ্গিয়ে করতেন সব কিছু।
গেল সেপ্টেম্বরে অন্যত্র বদলী হন ইউএনও নিশাত তামান্না। তার বদলীর আদেশ হওয়া মাত্র চলে যাওয়ার আগের দিন পিওন মহারাজের শেষ থাবা পড়ে উপজেলা জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। জনস্বাস্থ্য কর্মকর্তা কর্মস্থলে না থাকার সুযোগে এবং জনপ্রতিনিধিদের না জানিয়ে বিদায়ী ইউএনওকে দিয়ে তার পছন্দের তালিকায় শতাধিক পানির ট্যাংকি বিতরন করেন। বিনিময় তিনি ট্যাংকি প্রতি ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।
সুন্দরবন ইউপি চেয়ারম্যান একরাম ইজাদার জানান, গত ২৬ মে আঘাত হানা ঘুর্নিঝড় রিমালের আগমুহুর্তে জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে তৎকালীন ইউএনও জরুরী সভা করে তৎক্ষনিক আশ্রয় কেন্দ্র প্রস্তুত ও আশ্রয় কেন্দ্রে আগতদের তৎক্ষনিক খিচুরি সহ খাদ্য সহায়তার জন্য পরামর্শ প্রদান করেন। জনপ্রতিনিধিদের খরচের সেই জরুরী ত্রান তৎপরতার প্রায় ৫ লাখ টাকা মহারাজের বিল-বাউচারে উত্তোলন করে বিদায় মুহুর্তে পাড়ি দেন সাবেক ওই ইউএনও নিশাত তামান্না।
এছাড়া ঘুর্নিঝড় পরবর্তী বুড়ির ডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান উদয় শংকরের ইউনিয়নের ত্রান কার্যক্রমের দুইটন ত্রানের চাল ও মিঠাখালী ইউনিয়ন পরিষদে একটি এনজিও’র দেয়া ১৫ কার্টুন বিস্কুট তৎকালীন ইউএনও তলব করেন। ত্রানের ওই চাল পিওন মহারাজের নিয়ন্ত্রনে বিতরন করা হলেও ত্রানের বিস্কুট হাত বদল হয়ে কোথায় পৌছায় তা কেউ জানেন না।
মোংলা উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজার হাফিজ-মহারাজ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিগত (দিনে) অর্থ বছরে টেন্ডার ও ইজারা হতো। মহারাজ সিন্ডিকেট বিগত দিনে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকায় সুন্দরবন ইউনিয়নের চটেরহাট বাজার টেন্ডার ভাগিয়ে নেয়।
সেই হাট সম্প্রতি ৫ লাখ ৬০ হাজার টাকায় ইজারায় ওঠে। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও পৌর এলাকায় এমন আরও ৭টি হাট-বাজার রয়েছে। সুন্দরবন ইউনিয়নের চটেরহাট বাজারের ডাক ও ইজারা মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বেজায় চটেছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরের পিওন মহারাজ।
উপজেলার চিলা ইউপি চেয়ারম্যান আকবর গাজী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউপি সদস্যদের মাসিক সম্মানির ভাতা সহ বিভিন্ন প্রকল্প থেকেও পিওন মহারাজকে কমিশন দিতে হয়। দাপুটে এ পিওনকে সমিহ করে চলতে হয় জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের।
আ’লীগ সরকারের পতন হলেও পিওন মহারাজের দাপট কমেনি। এখনও উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন দপ্তরে তাকে সমীহ করতে হয়। নিজেকে রাজতৈকি অনুকুলের মতাদর্শের জাহির করে এখন নানা প্রভাব বিস্তার করছেন। এ অবস্থায় মহারাজ আতংকে আছেন কর্মকর্তা-কর্মচারী ও জনপ্রতিনিধিরা। বর্তমানে মহারাজ ও তার দোসর হাফিজ চক্র নিয়ন্ত্রন করছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তর। তবে উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করেন এ পিওন মহারাজ। তিনি নিজেকে সৎ ও স্বচ্ছ দাবি করে বলেন, যা কিছু অধিনস্থ কর্মকর্তার নির্দেশনা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করছি।
মোংলায় কর্মরত থাকতে আপনার বিরুদ্ধে বেশ কিছু অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছেন স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানসহ ভূক্তভোগী অনেকে। পানির ট্যাংকি বিতরণে জনপ্রতি ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা উৎকোচ গ্রহন, ঘুর্ণিঝড় রেমালে জরুরী ত্রাণ সহায়তা বাবদ ৪ লাখ ৬০০০০ টাকা আত্মসাৎ, বুড়িরডাঙ্গা ইউপিতে বিতরণকৃত ভিজিএফের চাল ও ত্রাণের বিস্কুট নিজ বাড়িতে নেওয়া, জন্মনিবন্ধন বাবদ জন প্রতি ২০০ টাকা উৎকোচসহ পিওন মহারাজের মাধ্যমে বিভিন্ন দুর্নীতি ও উৎকোচের টাকা আদায় প্রভৃতি।
এ প্রসংঙ্গে বিদায়ী মোংলা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা নিশাত তামান্না ভোরের পাতাকে বলেন , পানির ট্যাংকির জন্য ১ টাকাও নেয়া হয়নি, প্রতিটি অভিযোগ ভিত্তিহীন,ইউপি চেয়ারম্যানরা দলীয় কারন দেখিয়ে এ যাবত অনেককে ট্যাংকি থেকে বঞ্চিত করে আসছিলো তাদেরকে ট্যাংকি দেয়া হয়েছে। উপরে উল্লেখিত সকল অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবী করেন এ কর্মকর্তা।
আলোচিত দুর্নীতিবাজ এ পিওন এর দৌরাত্ন প্রসঙ্গে মোংলা উপজেলা (বর্তমান দায়িত্বে থাকা) নির্বাহী কর্মকর্তা আফিয়া শারমিন জানান, মৌখিকভাবে অনেক কিছু শুনেছি। তবে লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্ত স্বাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান তিনি।