॥ বাগেরহাট প্রতিনিধি ॥
বাঙ্গালীদের সংস্কৃতিতে গ্রাম্য মেলা এক অনন্য স্থান দখল করে রয়েছে। বছরের সকল ঋতুতে কোন না কোন উপলক্ষ্যকে সামনে রেখে এ মেলাগুলো আয়োজিত হয়ে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় দক্ষিন বঙ্গের অন্যতম একটি জনপ্রিয় মেলা পীর মেছের শাহ এর মেলা। এটি বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার চাঁদপাই ইউনিয়নের দক্ষিন চাঁদপাইয়ে পীর মেছের শাহের মাজারে প্রতি বছর ফাল্গুন মাসের পঞ্চম চাঁদের দিনে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাৎসরিক উরস উপলক্ষ্যে এই মেলায় তাই যোগ দিতে চলে আসেন ভক্তরা। আর এ অঞ্চলে তখন বিরাজ করে উৎসব মুখর পরিবেশ।
মেলাটির অন্যতম আকর্ষন দুই ঠোটে কুলুপ (এক ধরনের লোহার তালা) ফুটিয়ে জিকির করা। এবং জিকির করতে করতে একসময় সেগুলো খুলে যায়। আর এটি দেখার জন্য ছুটে আসে হাজার হাজার দর্শনার্থী।
শনিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি); সন্ধ্যায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দীপংকর দাশ আনুষ্ঠানিকভাবে এ মেলার উদ্বোধন করেন। এসময় মোংলা থানার ওসি মোহাম্মদ মনিরুল ইসলামসহ মেলার আয়োজক ও চাঁদপাই ইউপি চেয়ারম্যান মোল্লা তরিকুল ইসলাম ছাড়াও অন্যরা উপস্থিত ছিলেন।
মেলা আয়োজক ইউপি চেয়ারম্যান মোল্লা তরিকুল ইসলাম জানান, এ মেলাটি এ অঞ্চলের একমাত্র মেলা যেটি ১০০ বছরেরও অধিক সময় ধরে চলে আসছে। সংস্কৃতির এ ধারাটি এখানকার মানুষদের আবেগ ও অনুভুতির সাথে ওতপ্রত ভাবে মিশে আছে। এ মেলাতে ঘর গৃহস্থালির প্রায় সব রকম জিনিসপাত্র সুলভ মূল্যে পাওয়া যায়। এখানে কসমেটিকস পন্য, শিশুদের খেলনা, বাশ ও বেতের জিনিস পত্র, মাটির পুতুল, কাঠ ও প্লাইউডের আসবাব পত্র পাওয়া যায়। এছাড়াও এখানে রয়েছে নানা রকমের খাবাররর দোকান। বিভিন্ন রকম মিষ্টির পসরা সাজিয়ে বসেছেন ময়রারা। বিনোদনের জন্য রয়েছে নাগর দোলা, চড়কি প্রভৃতি।
সম্মেলিত সাংস্কৃতিক জোটের মোংলার সভাপতি মোঃ নুর আলম শেখ বলেন, বিনোদন বলতে জীবন থেকে অনেক কিছু হারিয়ে গেছে। প্রতিটি মানুষের জন্য সুস্থ বিনোদন প্রয়োজন আছে। কিন্তু তা আজ খুঁজে পাওয়া যায়না তবে মোংলায় শত বছরের পুরোনো পীর মেছের শাহ মেলাটি এখনও টিকে আছে৷ এখান থেকে কিছুটা হলেও গ্রামীণ বিনোদন উপভোগ করা যায়। তাই এই প্রচোলন ধরে রাখতে সংশ্লিষ্টদের আরও দায়িত্বশীল হওয়ার আহবান জানান তিনি।
এমেলায় স্থানীয়দের পাশাপাশি অন্যান্য উপজেলা থেকে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসবেন। মেলার আনন্দ ভাগাভাগি করার জন্য ধর্ম বর্ন নির্বিশেষে এ অঞ্চলের মেয়ে জামাইদেরও বাবার বাড়িতে আনতে যাওয়ার প্রচলন রয়েছে বলেও জানান তিনি।
মেলাটির অন্যতম আকর্ষন দুই ঠোটে কুলুপ (এক ধরনের লোহার তালা) ফুটিয়ে জিকির করা। এবং জিকির করতে করতে একসময় সেগুলো খুলে যায়। আর এটি দেখার জন্য ছুটে আসে হাজার হাজার দর্শনার্থী। আগামীকাল মঙ্গলবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০ টায় মেলার এ বিশেষ কাজটি করবেন চারজন সাধক ফকির।
এ বিষয়ে কথা হয় মাজারটির অন্যতম সাধক ভক্ত আলী আকবর ফকির এর সাথে। তিনি বলেন, তারা শুনেছেন তাদের দাদাদের কাছ থেকে- খান জাহান আলীর পরপরই পীর মেছেরশাহ এ অঞ্চলে আসেন ইসলাম প্রচারে। ইংরেজদের আমল থেকেই এ অঞ্চলে তিনি ধর্ম প্রচার করতে থাকেন। তার আধ্যাতিক ক্ষমতা বলে অনেক আশ্চর্য সাধন করায় তখন থেকেই অনেক ভক্ত/অনুসারী গড়ে ওঠে ওনার।
তিনি আরও বলেন, ১০০ বছরেরও বেশী সময় ধরে এখানে উরশ চলে আসছে এবং এখন সেটি কলেবরে অনেক বেশী জাকজমকতায় পরিপূর্নরুপ লাভ করেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার কল্যানে এখন অনেক দুর দুরান্ত থেকে ভক্তরা এখানে এসে পীর মেছের শাহ এর মাজারে জিকির করে থাকেন। অনেকের বিশ্বাস এখানে কোন কিছুর মানত করলে তা পূরন হয়। এ বিশ্বাসটি এতটাই প্রবল যে অনেক মানুষ তার জন্যই এখানে আসতে থাকে এ মেলাকে সামনে রেখে।
মেলায় আসা খুলনা থেকে আগত ৫০ বছর বয়সী রাজু আহমেদ টোকন বলেন, তিনি ছোটবেলা থেকে তার বাবার সাথে এ মেলায় আসতে শুরু করেন। এবার তারা বরাবরের ন্যায় বাস যোগে ৫৫ জনের একটি দল এসেছেন। সাথে এনেছেন হারমোনিয়াম, চাকতি, ঢোল ও শব্দযন্ত্র। তারা গান বাজনার মাধ্যমে এ মেলাটিকে আরও বেশি জাকজমক করে তুলবেন বলে জানান তিনি।
শ্যামলী রায় নামে এক দর্শনার্থী বলেন, এ মেলায় ধর্ম বর্ন নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষের জমায়েত হয়। এখানে আমরা কসমেটিকস, খেলনা থেকে শুরু করে বাশ, বেত ও মাটির তৈরি ঘর গৃহস্থালির জিনিস পত্রের পাশাপাশি স্টিল ও কাঠের আসবাব পত্র পাওয়া যায়। কাল থেকে ভীড় হবে অনেক, তাই আগে ভাগেই দেখতে এসেছি কী কী এসেছে মেলায়। পরে সময় করে এসে কিনব।”
মোংলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম বলেন, মেলাকে ঘিরে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পুলিশের সদস্যরা শিফট ওয়ারী তাদের দায়িত্ব পালন করছেন।